Friday, September 11, 2015

কারিগরি শিক্ষার্থীদের জন্য নোট (ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রইং – ১ম পর্ব):


কারিগরি শিক্ষার্থীদের জন্য নোট (ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রইং – ১ম পর্ব):
 
ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রইং (Drawing) কি বা কেন দরকার?
ড্রইং কে এক ধরণের ভাষা বলাই ভাল। দুজন মানুষ যেমন উভয়ের পরিচিত ভাষার মাধ্যমে সহজে ভাবের আদান প্রদান করে, দুজন প্রকৌশলীও (তিনি যে ভাষার, যে দেশেরই হন না কেন) ড্রইংভাষার মাধ্যমে তাদের কাজের তথ্যের আদান প্রদান করতে পারেন। প্রকৌশল বিদ্যায় যুগযুগে ড্রইংএকমাত্র ও সার্বজনীন ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ভাব প্রকাশের ভাষার মতো ড্রইংনির্মাণশৈলীর তথ্য সরবরাহ ও বক্তব্য উপস্থাপনের ভাষা । একজন প্রকৌশলী সেই ভাষাতেই তার বক্তব্য উপস্থাপন করেন। তাই নিজেকে প্রকৌশলী হিসেবে তৈরি করতে প্রতিটি শিক্ষার্থীর এই ভাষাটি (ড্রয়িং) ভালভাবে রপ্ত করতে হয়। এই ভাষাতে যিনি যত ভাল হবেন, প্রকৌশলী হিসেবে

তার বক্তব্য তত স্পষ্ট হবে ও তিনি সবার মাঝে উজ্জ্বল হয়ে উঠবেন।
কোন বস্তু (Object) সম্পর্কে সঠিকভাবে বোঝা বা সেটিকে বাস্তবে রূপান্তরিত করার জন্য প্রথমেই দরকার ঐ বস্তুর গঠন, পরিমাপ ও উপাদান সম্বন্ধে বিস্তারিত ধারণা। ড্রয়িং এর মাধ্যমে কোন বস্তুকে তুলে ধরা হলে সেটিকে ওই বস্তুর ডিজাইন বলা হয়। কর্মক্ষেত্রে যেকোনো মেশিন স্থাপন, দালান তৈরি, অন্যান্য স্থাপনা তৈরি, ইত্যাদি কাজে, সকল ধরনের প্রয়োজন ও অবকাঠামো বিবেচনা করে প্রথমে তৈরি করা দরকার হয় ড্রইং ডিজাইন। এই ড্রইং করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে প্রয়োজনীয় সকল বস্তুর সব ধরণের পরিমাপ, স্থাপনের জন্য কি ধরনের বা কতটুকু অবকাঠামো প্রয়োজন, ইত্যাদি। ড্রয়িং এর মাধ্যমে ক্রমশ পরিকল্পনাটি পরিপক্ব হয়ে বাস্তবের কাছাকাছি চলে আসে। ডিজাইনে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা ছাড়াও অন্যান্য প্রকৌশলীর পক্ষে সেটি নিরীক্ষণ করা সহজ হয়। এর পর সেই ড্রয়িং এর নির্দেশনা অনুযায়ী টেকনিশিয়ান সহ পুরো টিম ওই কাজটি নিখুঁত ভাবে সম্পন্ন করতে পারে। সুতরাং প্রতিটি প্রকৌশলীর ড্রইং সম্বন্ধে উপযুক্ত জ্ঞান লাভ কেবল আবশ্যকই নায় অপরিহার্যও বটে।
পৃথিবীর সকল ভাষার যেমন নিজস্ব নিয়মকানুন বা ব্যাকরণ রয়েছে, ড্রয়িং ভাষারও তেমন নিয়ম কানুন ব্যাকরণ রয়েছে। এসকল নিয়মকানুন ভালভাবে রপ্ত করার জন্য লেখাপড়ার পাশাপাশি নিয়মিত অনুশীলন দরকার। ড্রইং বিষয়ে প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও নিয়মিত অনুশীলনের প্রয়োজন মেটাতে আমাদের এই ম্যানুয়ালটি লেখার এই আয়োজন।
প্রসঙ্গত আসে কম্পিউটার এইডেড ড্রয়িং এর কথা। বর্তমান সময়ে ড্রইং সহজ করার জন্য কম্পিউটার এইডেড ড্রয়িং এর প্রচলন হয়েছে। এখন কম্পিউটারের কল্যাণে প্রকৌশলীদের জীবন অনেক সহজ হয়েছে। একজন প্রকৌশলী আগের চেয়ে অনেক কম সময়ে অনেক নিখুঁত ভাবে অনেক বেশি ডিজাইন করতে পারেন। বিশেষকরে সংশোধন, পরিবর্ধন, পরিমার্জনের ক্ষেত্রে কম্পিউটারের অবদান অসাধারণ। কিন্তু মনে রাখতে হবে, কম্পিউটার শুধু ড্রয়িং কে সহজ করার জন্য, পুরো কাজটি করে দেবার জন্য নয়। যিনি ড্রয়িং ভাল জানেন, কম্পিউটার শুধু তার কাজকে সহজ করে। যিনি ড্রইং ভালোমতো জানেন না, কম্পিউটার তাকে বিশেষ সাহায্য করতে পারবে না। তাই ভাল প্রকৌশলী হবার জন্য হাতে কলমে ড্রইং শেখাতে মনোযোগী হতে হবে। পাশাপাশি কম্পিউটারে সেটির বাস্তবায়নও শিখতে হবে।
ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রয়িং ও চিত্রকলা (পার্থক্য):
ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রইং এবং চিত্রকলা দুটি বিষয়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় মিল হল প্রকাশ মাধ্যমঅঙ্কন। কিন্তু দুটি বিষয়ের উদ্দেশ্য, গঠন বা ব্যাবহার মোটেই এক নয়। ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রইং বস্তু সম্পর্কে পূর্ণ ও গাণিতিক পরিমাপকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়। গাণিতিক অনুপাত ঠিক রেখে নিখুঁতভাবে লেখা-চিত্রের মাধ্যমে বস্তু কে উপস্থাপন করা হয়। মাধ্যম কাগজ বা কম্পিউটার স্ক্রিন হতে পারে। সেখানে অনুভূতি, ভাবাবেগের যায়গা নেই বললেই চলে।
চিত্রকলার বেলায় বস্তুর গাণিতিক পরিমাণ ফুটিয়ে তোলা শিল্পীর প্রধান কাজ নয়, নান্দনিক উপস্থাপনটিই মুল কাজ, সেখানে গাণিতিক পরিমাণ নিয়ে বিশেষ মাথা ব্যথা নেই। শিল্পী যেকোনো বস্তু বা বিষয়কে উপস্থাপন করেন রং তুলি, পেনসিল, আলোছায়া ইত্যাদির বিন্যাসে। সেখানে পরিমাপের বিষয় হতে নান্দনিকতার গুরুত্ব বেশি। ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রইংএর বেলায় রেখন শিল্পী বানকশাকারএর এই জাতীয় কোন স্বাধীনতা থাকে না। অংকন করার সময় তাকে কতগুলি নির্দিষ্ট কঠোর নিয়ম অনুসরণ করতে হয়। ব্যস্তটির গঠন, পরিমাপ ইত্যাদি প্রতিটি বিষয়কে একমাত্র রেখার মাধ্যমেই বিশদভাবে জানাতে হয়। তবে অনেকের গাণিতিক ড্রয়িং এর সাথে সামান্য চিত্রকলা মিশিয়ে মজার চিত্রকলার জন্ম দেন।
ড্রইং এর শ্রেণীবিভাগ (Classification of Drawing):
ড্রইং প্রধানত দুই প্রকার:
(ক) চিত্রকলা বা শৈল্পিক ড্রইং (Artistic or Free hand or Model Drawing) : শিল্পী তার হৃদয়ের অনুভূতিকে বিভিন্ন ভাবে ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করে। নান্দনিকতা আনতে ইচ্ছেমত যোগ বিয়োগ করে। যেকোনো বস্তু বা ধারনাকে সরাসরি দেখে বা নিজের কল্পনায় নিয়ে এসে কাগজ, কাপড়, বোর্ড ইত্যাদিতে উপস্থাপন করার কৌশলকেই চিত্রকলাবা শৈল্পিক ড্রইংবলে। এর জন্য, রং, তুলি, পেনসিল, আলো-ছায়া ইত্যাদি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়। এই ধরণের ড্রইং এর বেলায় গণিতক পরিমাপ যোগ কোন বিবেচ্য বিষয় হয় না।
(খ) কারিগরি বা ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রইং (Technical or Engineering Drawing): আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি রীতিনীতি অনুসারে কতগুলি তাৎপর্য মণ্ডিত রেখা, প্রতীক, চিহ্ন, পরিমাপ ও কিছু শাব্দিক ব্যবহার যোগে ছবির মাধ্যমে কোন বসকে বা ইঞ্জিনিয়ারদের কল্পনা প্রসৃত চিন্তা-ভাবনাকে সুশৃঙ্খল বা সু-সংঘবদ্ধভাবে উপস্থাপন বা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের কৌশলকে কারিগরি বা ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রইংবলে। ছোট বড় ইমারত, সড়ক, ব্রিজ-কালভার্ট, মেশিন বা যন্ত্রপাতিসমূহ এই ড্রইং এর অন্তর্ভুক্ত।
কারিগরি বা ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রইং এর শ্রেনীবিভাগ:
(ক) জ্যামিতিক ড্রইং (Geometrical Drawing) : জ্যামিতিক বসসমূহ যেমন, বর্গক্ষেত্র, আয়তক্ষেত্র, ত্রিভুজ, কোন, সিলিন্ডার, গোলক ইত্যাদি কাগজের উপরে রেখার মাধ্যমে উপস্থাপন কৌশলকে জ্যামিতিক ড্রইং বলে।
(ক.১) প্লেইন জ্যামিতিক ড্রইং (Plane Geometrical Drawing): দ্বিমাত্রিক বসগুলি, যেমন, আয়তক্ষেত্র, বর্গক্ষেত্র, ত্রিভুজ ইত্যাদি কাগজের উপরে রেখার মাধ্যমে উপস্থাপন করাকে প্লেইন জ্যামিতিক ড্রইংবলে।
(ক.২) সলিড জ্যামিতিক ড্রইং (Solid Geometrical Drawing): ত্রিমাত্রিক বসগুলি যেমন, কোন, সিলিন্ডার, গোলক ইত্যাদি কাগজের উপরে রেখার মাধ্যমে উপস্থাপন করাকেসলিড জ্যামিতিক ড্রইংবলে।
(খ) যান্ত্রিক ড্রইং (Mechanical Drawing) : এই ড্রইং এর মাধ্যমে কোন ডিজাইনার মেশিন, মেশিনারি পার্টস, ইঞ্জিন, ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ প্রভৃতি যন্ত্রপাতি বা দ্রব্য সামগ্রীর কার্যপদ্ধতি, সংযোগ, পরিচালনা, উপাদান, সংমিশ্রণ ইত্যাদির গুণাবলী বর্ণনা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে উপস্থাপন কৌশলকে যান্ত্রিক ড্রইংবলা হয়।
(১) পাত-চাদর ধাতুবিদ্যা ড্রইং (Sheet Metal Drawing) : বিভিন্ন ধাতুর তৈরি পাতলা চাদরের মাধ্যমে তাপ, বায়ু সঞ্চালন, বাতাসের বিশুদ্ধ ক্রিয়া ও তার নিয়ন্ত্রণ কাজে ব্যবহৃত যে ড্রইং করা হয় তাকে পাত-চাদর ধাতু-বিদ্যা ড্রইংবলে।
(২) সামুদ্রিক ড্রইং (Marine Drawing) : ডক-ইয়ার্ড তৈরির কারখানায় ব্যবহারের জন্য যে ড্রইং করা হয় তাকে সামুদ্রিক ড্রইংবলে।
(৩) বায়ু কৌশল ড্রইং (Air-craft Drawing) : বিমান চালনা সংক্রান্ত ও বিমান তৈরির কারখানায় বিভিন্ন ডিজাইনের জন্য যে ড্রইং করা হয় তাকে বায়ু কৌশল ড্রইংবলে।
(৪) খাস কামরা ড্রইং (Furniture Drawing) : ঘরে ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন ফার্নিচার বা আসবাবপত্র ডিজাইনের কাজে এই ড্রইং করা হয়।
(গ) পুর-কৌশল ড্রইং (Civil Drawing) : সড়ক, দালান-কোঠা, ব্রিজ-কালভার্ট, বাঁধ ইত্যাদি কাজে ব্যবহৃত ড্রইংকে পুর-কৌশল ড্রইংবলে।
(১) কাঠামো গঠন সম্পর্কীয় ড্রইং (Structural Drawing) : দালান-কোঠা, ব্রিজ, ষ্টীল স্ট্রাকচার ইত্যাদির কাজে এই ড্রইং ব্যবহৃত হয়।
(২) ম্যাপ ড্রইং (Map Drawing) : সরকারী-বেসরকারি কাজে, জমি, রাস্তা, খাল-বিল, বিশেষ স্থাপনা ইত্যাদির জন্য এই ড্রইং করা হয়।
(ঘ) স্থপত্যিক ড্রইং (Architectural Drawing) : দালানের কাঠামোর বিভিন্ন অংশেডেকোরেটিভ’ (Decorative) কাজ ও আসবাবপত্রের অবস্থান দেখিয়ে যে ড্রইং করা হয় তাকে স্থাপত্যিক ড্রইংবলে। উদাহরণ সরূপ ল্যান্ডস্কেপ’(Land Scape) দালানের অভ্যন্তরীণ সাজ-সজ্জামূলক ছবি এই ড্রইং এর অন্তর্ভুক্ত।
(ঙ) তড়িৎ-কৌশল ড্রইং (Electrical Drawing) : দালান-কোঠা ও অন্যান্য অবকাঠামোতে বৈদ্যুতিক তার ও সরঞ্জাম এর অবস্থান দেখিয়ে যে ড্রইং করা হয় তাকে তড়িৎ কৌশল ড্রইংবলে।তৈরি কাজে যে ধারাবাহিক ডায়াগ্রাম কাগজে উপস্থাপন করা হয় তাকে ইলেক্ট্রনিক ড্রইংবলে।
{ ইন্টারনেট হতে সংগ্রহীত } কবির তালুকদার। হাইমচর, চাঁদপুর।