Thursday, October 15, 2015

ভালবাসার গল্প

সকালের নাস্তার টেবিলে ইরা কে কেমন যেন গম্ভীর
দেখলাম । আমি নাস্তা করছিলাম । ও চুপচাপ বসে ছিল ।
কিছু খাচ্ছিল না । বললাম
-কি ব্যাপার খাচ্ছ না কেন ?
-এখন খেতে ইচ্ছা করছে না ।
-এখন করছে না মানে কি ? অফিসে যাবে না ?
-আজকে ভাবছি অফিসে যাবো না ।
-কেন ? শরীর ভাল আছে তো ? জ্বর আসেনি তো ?
আমি ইরার কপালে হাত দিলাম ।
-না তেমন কিছুই হয়নি । এমনি ইচ্ছা করছে না ।
আমি নাসতা খেয়ে উঠতে যাবো এমন সময় দেখলাম ইরা
আমার হাত ধরে বসাল । বলল
-কাল রাতে ঘটনার জন্য আমি সরি । খুব বেশি সরি ।
-না ঠিক আছে । কিন্তু ঠিক বুঝতে পারলাম না তুমি
এমনটা কেন করলে ?
ইরা বলল
-তুমি জয়িতার সাথে কথা বলছিলে এটা আমার একদম
সহ্য হচ্ছিল না । বারবার মনে হচ্ছিল আমার কাছ থেকে
কি যেন হারিয়ে যাচ্ছে । মনে হচ্ছিল আমার কিছু একটা
অন্য কেউ নিয়ে যাচ্ছে ।
বলতে বলতে ইরা বাচ্চা মেয়েদের মত কেঁদে ফেলল ।
চেয়ার থেকে উঠে ওকে জড়িয়ে ধরলাম । বললাম
-বোকা মেয়ে ! আমি তোমার হাজবেন্ড ! তোমার কাছ
থেকে কে আমাকে নিয়ে যাবে বল ?
ইরা আমাকে আর একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরল । যেন আমি
কোথাও হারিয়ে যাচ্ছি । ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল
-কিন্তু জতিয়াকে তো তুমি ভালবাসতে ।
-বাসতাম । ও তো আমার পাস্ট । আর তুমি আমার
প্রেজেন্ট আর ফিউচার । তুমি কেন ওর সাথে নিজেকে
তুলনা করছো ?
-আমি জানি না । তুমি আর ওর সাথে কথা বলবা না ।
-আচ্ছা বাবা বলবো না । আর জয়িতা অল্প কয়েক দিনের
জন্য এসেছে । ও চলে যাবে । কেবল ভার্সিটির
রিইউনিয়নের জন্য এসেছিল । আমি এবার অফিসে যাই ?
-আচ্ছা ।

ইরা একটু হাসলো ।
ইরাকে একটা মিথ্যা কথা বলতে হল দেখে একটু খারাপই
লাগছে । ওকে বললাম যে জয়িতার সাথে আর দেখা
করবো না । কিন্তু দেখা না করলে কিভাবে হয় ?
গত কাল ওর সাথে ঠিকমত কথা হয় নি ।
আমি খুব ভাল করেই জানি জয়িতা কেবল আমার সাথেই
দেখা করার জন্য দেশে এসেছে । ঘর থেকে বেরতে না
বেরতেই জয়িতার ফোন ।
-বল ।
-তোমার হ্যালো না বলার অভ্যাসটা আর গেল না , না ?
আমি হাসলাম ।
-মন ভাল তোমার ?
জয়িতারও দেখছি অভ্যাসটা যাই নি । ও সব সময় ফোন
করে আমাকে জিজ্ঞেস করত মন ভাল কিনা । যদি
একবার ফোন রেখে ১০ মিনিট পরে আবার ফোন দিতাম
তবুও এই প্রশ্নটা করতোই ও ।
একবার কি হয়েছে । ওর সাথে খুব ঝগড়া হয়েছে । একবার
ঝাড়ি দিয়ে ফোন রেখেছি । কিছুক্ষন পর আবার ফোন
দিয়েছি আরেক দফা ঝাড়ি দেবার জন্য । ফোন রিসিফ
করেই জয়িতা খুব আদুরে গলায় বলল
-মন ভাল তোমার ?
এমনিতে আমরা একে অপরকে তুই করে বলতাম । কিন্তু
মাঝে সাঝে ও আমাকে তুমি করে বলত । বিশেষ করে
যখন আমি রেগে যেতাম ।
আমি আর কিছু বলতেই পারলাম না । এই মেয়েকে কি
বেশি কিছু বলা যায় ?
-তোমায়ও তো অভ্যাসটা যায় নি ?
জয়িতা বলল
-তুমি আসছো তো ?
-হুম । আসবো না কেন ?
-না মানে , তোমার ওয়াইফ তো পছন্দ নাও করতে পারে ।
-ইরা পছন্দ করবে না ।
-তবুও আসবে ?
-হুম আসবো ।
- কেন ?
-জয়ি ইরা আমার কাছে ইম্পর্টেন্ট । কিন্তু তুমিও আমার
কাছে কম জরুরী না !
-আচ্ছা ! বুঝলাম । এসো তাহলে ! কেমন ? আমি অপেক্ষা
করছি ।
আমি ফোন কেটে দিলাম । রিক্সাওয়ালাকে
এলিফ্যান্ট রোডের দিকে যেতে বললাম । জয়িতার এক
মামার বাড়ি ঐ দিকটায় । আপাতত জয়ি ওখানেই
উঠেছে ।
আজ কতদিন পর জয়িতার সাথে দেখা করতে যাচ্ছি ।
প্রায় সাত বছর তো হবেই । আজ কতদিন পর ওর সাথে একটু
কথা বলব ভালভাবে । আগে এমন কোন দিন ছিল না যে
আমরা দেখা করতাম না ।
আমার এখনও খুব ভাল করে মনে আছে ওকে যেদিন
প্রোপজ করি । ও খানিকটা অবাক হলেও নিজেকে
সামলে নিয়েছিল । বলল
-দেখ আবীর ইটস নট ফানি ।
-আরে ফানির কি দেখলি ? তোকে প্রোপজ করেছি
আমি ।
-ওয়েল দেন আই ক্যান রিজেক্ট ইউ ইফ আই ওয়ান্ট ।
-রিজেক্ট করেই দেখ !
জয়িতা কিছুক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে থাকল । বলল
-তুই যেটা চাচ্ছিস সেটা সম্ভব না ।
- কেন সম্ভব না ? আমাকে তুই একটা যুক্তি যুক্ত কারন
দেখা ।
-দেখ আবীর তুই কি জোর করে আমার মুখ থেকে হ্যা
বলাবি ?
-প্রয়োজন হলে তাই ।
জয়িতা কি বলবে ভেবে পেল না । আমি বললাম
-তুই আমাকে রিফিউজ কেন করবি বল ? একটা কারন
আমাকে দেখা ।
জয়িতা এবারও কোন কথা বলল না । কেবল আমার দিকে
তাকিয়ে থাকল ।
-বল আমাকে অপছন্দ করিস ? বল । করিস অপছন্থ ?
জয়ি মাথা নাড়ল ।
-অন্য কাউকে ভালবাসিস ?
এবার ও মাথা নাড়ল ।
-আমি যদি অন্য কোন মেয়ের সাথে এঙ্গেইজ হই , তোর
ভাল লাগবে ?
জয়িতা কোন উত্তর দিলো না ।
- কি কথা বলছিস না কেন ?
জয়িতা ক্ষীন গলায় বলল
-তুই কারো সাথে এঙ্গেইজ হলে আমার কি ?
- কি বললি তুই ? আমার কি ? তাহলে ঐ দিন তুই রেগে
গিয়েছিলি ক্যান ?
-কোন দিন ?
-পহেলা বৈশাখের দিন । আমি তোকে বাদ দিয়ে নীলুর
সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম । তুই রেগে গিয়েছিলি কেন ?
পুরো এক দিন আমার সাথে কথা বলিস নি মনে আছে ।
-আহা রাগবো না ? আমি তোমার জন্য সেজেগুজে
আসবো আর তুমি অন্য মেয়ের সাথে ঘুরে বেড়াবা !
-তাহলে ?
-তাহলে কি ?
-তুই কি বুঝতে পারছিস না নাকি বুঝতে চাচ্ছিস না ?
জয়িতা অন্য দিকে তাকালো । আমি হাত দিয়ে ওর
মুখটা স্পর্শ করলাম । দেখলাম ওর চোখে পানি চলে
এসেছে । ওর চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বললাম
-জয়ি , তুই এমন কেন করছিস বলবি আমাকে ?
-আবীর প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা কর । এই সম্পর্ক কেবল
কষ্টই দেবে । আর কিছু না ।
-আমি আর কিছু জানি না । আমি আজ রাত তোকে সময়
দিলাম । তুই যদি কাল সকালের আগে আমাকে ফোন না
দিস এবং……
বলে একটু থাকলাম । জয়িতা বলল
-এবং ?
-এবং তোর আনসার যদি পজেটিভ না হয় তাহলে দেখিস
। আমি গেলাম ।
আমি জানতাম জয়িতা ফোন করবেই । রাত আড়াটার
দিকে জয়িতার ফোন এসে হাজির ।
-কি করিস ?
-ছাদের উপর বসে আছি ।
-ছাদের উপর কি করিস ?
-জায়গা খুজছি ?
- কেন ?
-না কোন জায়গা থেকে লাফ মারবো তাই ঠিক করছি ।
-আবীর মার খাবি কিন্তু । তুই এক্ষনি রুমে আয় । এক্ষনি
আয় ।
-আগে হ্যা বল ।
-আবীর প্লিজ রুমে আয় । প্লিজ ।
আমি হেসে উঠলাম । বললাম
-ভয় নাই । আমি রুমেই আছি । তোকে একটু ভয় দেখালাম ।
জয়িতা কোন চুপ করে থাকল । কথা বলল না । আমি
বললাম
-কি হল কথা বলছিস না কেন ?
একটু কান্নার আওয়াজ পেলাম ।
-আরে কাঁদছি কেন ?
-তুই সব সময় আমাকে জ্বালাতন করিস । তুই জানিস না তুই
আমার কাছে কি ?
-জানি তো !
-তাহলে এমন কেন করিস ?
-আই লাভ ইউ বল ।
জয়িতা হাসল ।
- তুই এতো বোকা কেন ? সব কথা কি বলার দরকার হয় ।
-না । তবুও বল ।
-আচ্ছা বাবা বলছি ।
জয়িতা একটু চুপ করল ।
জয়িতার বাসায় পৌছাতে পৌছাতে ঘন্টা খানেক
লেগে গেল । আগে অনেক বার এসেছি এই বাড়িটার
সামনে । জয়িতা প্রায়ই আবদার করতো ওকে বাসা
থেকে নিয়ে যেতে । কিন্তু একটা ব্যাপার প্রায়ই হত ।
আমি যখনই ওর বাড়ির সামনে এসে হাজির হতাম ঠিক
তখনই ওর ফোন আসতো আমার মোবাইলে । ফোন করে
বলতো
-বেল বাজাবি না । আমি নামছি ।
আমার মনে হত ও আমার জন্য জানলা দিয়ে তাকিয়েই
থাকতো । আমাকে বেল বাজানোর সুযোগ দিতো না ।
কিন্তু আজ আর ঐ রকম কিছু হল না । আমি কিছুটা সময়
অপেক্ষা করলাম যদি ওর ফোন আসে ! শেষে নিজেই
ফোন দিলাম ।
-চলে এসেছো ?
-হুম ।
-উপরে এসো । তিন তালার বা পাশের ফ্লাট । মনে নেই
তোমার ?
আমার প্রতি ও আগে থেকেই আসক্ত ছিল কিন্তু হ্যা
বলার পর থেকে আমি ছাড়া আর কিছু যেন বুঝতোই না ।
সেই সকাল বেলা থেকে আমাদের একসাথে পথ চলা শুরু
হত দুপুর বেলা পর্যন্ত চলত । যে দিন মাত্র একটা ক্লাস
থাকতো সেই দিনও পুরোটা সময় একসাথে থাকা চাই ।
ওর এমন আচরন করাটা হয়তো আমি বুঝতে পারতাম ।
জয়িতা তখন সিক্সে পড়ত যখন ওর বাবা মার ডিভোর্স
হয়ে যায় । ও বাবা মা কারো কাছেই থাকে নি । সত্যি
কথা বলতে ওর বাবা মা ইচ্ছা করেই জয়িতাকে নিজের
কাছে রাখে নি । মাসে মাসে কেবল খরচ পাঠিয়ে
দিতেন । কিন্তু ভালবাসা পাঠান নি কখনও ।
জয়িতা বলতে গেলে তারপর থেকে হোস্টেলেই বড়
হয়েছে । মাঝে মাঝে যেত ওর মামার বাড়িতে । কারো
কাছ থেকে না ঠিক মত ভালবাসা পেয়েছে আর না
কাউকে ঠিক মত ভালবাসতে পেরেছে । তাই আমাকে
পাবার পর থেকে যেন এতো দিনের সব না পাওয়া
ভালবাসা আমার কাছ থেকে পুষিয়ে নিচ্ছিল ।
কিন্তু একটা ব্যাপার আমার কাছে সব সময় খুব অদ্ভুদ
লাগতো । ও কথনই আমার বিয়ের কথা বলত না । কেমন
যেন এড়িয়ে যেত । পড়া লেখা শেষ করে যখন চাকরীতে
ঢুকলাম স্বাভাবিক ভাবেই ওকে বিয়ে করতে চাইলাম ।
ও বলল
-তোর ফ্যামিলির সাথে আগে কথা বল ।
আমি আমার মাকে বললাম । সব শুনে মা রাজি হলেন না
। তার এক কথা ব্রোকেন ফ্যামিলির কোন মেয়ে তার
ছেলের বউ হবে না । কত ভাবে বোঝাতে চাইলাম কিন্তু
কিছুতেই মাকে রাজি করাতে পারলাম না ।
কথা গুলো যখন জয়িতা কে বললাম ও একটুও অবাক হল না।
ওর মুখ দেখে বুঝলাম ও যেন আগে থেকেই জানতো
এমনটা হবে ।
কলিংবেল চাপতেই দরজা খুলে গেল । আমি
ভেবেছিলাম জয়িতাকে দেখবো । কিন্তু দরজা খুলল
পাঁচ ছয় বছরেয় একটা মেয়ে । এতো মিষ্টি চেহারা
মেয়েটার । আমাকে দেখে মিষ্টি একটু হাসল । আর
কেবল আমার দিকেই তাকিয়ে থাকল ।
আমি বললাম
-তোমার নাম কি ?
-তোমাকে কেন বলব ?
-শশী এসব কি হচ্ছে ?
জয়িতাকে ঘরে ঢুকতে দেখলাম ।
-কেউ নাম জিজ্ঞেস করলে নাম বলতে হয় ! জানো না?
ছোট্ট মেয়েটা গিয়ে জয়িতাকে জরিয়ে ধরল ।
জয়িতা আগের মতই আছে । গতকালকের অনুষ্ঠানে ইরার
জন্য ওকে ঠিক মত দেখতে পারি নি । আমি বললাম
-ভাল আছো তো ?
-তুমি এসেছো না ! এখন ভাল আছি ।
-আগের মতই আছো ?
জয়িতা হাসল ।
-আচ্ছা এই মিষ্টি মেয়েটা কে ?
জয়িতা শশীকে কোলে নিল । জয়িতা হাসল । জয়িতাকে
হাসতে দেখে শশীও হাসল । জয়িতা বলল
-বলতো কে ?
-ওমাইগড ! এটা তোমার মেয়ে ? সত্যি তোমার মেয়ে ?
এতো বড় হয়ে গেছে ? দেখি একটু কোলে নেই ।
শশীকে কোলে নিলাম । কেমন যেন আফসোস হল নিজের
মনের মধ্যে । এই মিষ্টি মেয়েটা আমার নিজের হতে
পারতো ! কোলে নিতেই শশী আমাকে জড়িয়ে ধরল ।
একটা ভাল লাগা বয়ে গেল আমার পুরো মন জুরে ।
-এতো মিষ্টি মেয়ে তোমার ?
---
তারপর থেকে জয়িতা যেন কেমন বদলে গিয়েছিল ।
আমার দিকে যখন তাকাত কেমন যেন একটা বিষন্নতা ওর
চেহারায় ফুটে ওঠত । মনে হত ওর কাছ থেকে কি যেন
একটা হারিয়ে যাচ্ছে । আর ও সেই জিনিসটাকে ধরে
রাখার জন্য কিছুই করতে পারছে না । আমি কত কথা
বলতাম । ও কিছু বলত না । আমি আর থাকতে পেরে ওকে
বললাম
-তুই এমন কেন করছিস ?
-কেমন করছি ?
-এমন মন খারাপ করে কেন থাকিস ?
জয়িতা কোন জবাব দিল না । আমি বললাম
-আমি তোকেই বিয়ে করবো ! কে রাজি হোক বা না
হোক ! তুই বুঝলি আমার কথা ?
জয়িতা হাসল । বিষন্নতার হাসি !
-আবীর ! আমি তোকে বিয়ে করবো না । তুই কি জানিস
মানুষের জীবনে মা বাবা কতটা ইম্পর্টেন্ট ! তাদের
কাছে থাকাটা কত বেশি জরুরী ! অনেক বেশি জরুরী ।
-কিন্তু ..
-কোন কিন্তু না । তোর মা তোকে ২৪ বছর ধরে ভালবাসে
। বুকের একটু একটু ভালবাসা দিয়ে তোকে বড় করেছে ।
আমার ২৪ মাসের ভালবাসা ঐ ২৪ বছরের ভালবাসার
কাছে কিছুই না । তোর মাকে কিছুতেই কষ্ট দিস না ।
আমি হলে দিতাম না । তোরও দেওয়া উচিৎ না ।
তারপর থেকে জয়িতা আমার সাথে যোগাযোগ কমিয়ে
দিল । আমি যোগাযোগ করতে চাইলেও ও করতো না ।
-----
আবার বললাম
-তোমার মেয়েটা এতো মিষ্টি হয়েছে ! একদম তোমার
মত । দেখতেও হয়েছে একদম তোমার মত ।
জয়িতা হাসল । এর চোখ দুটোতে কেমন যেন একটা রহস্য
দেখলাম । ও বলল
-সবকিছু কিন্তু আমার মত না । চোখ দুটো হয়েছে একদম ওর
বাবার মত ।
আমি শশীর চোখের দিকে তাকালাম । আসলেই শশীর
চোখ দুটো জয়িতার মত না । কেন জানি চোখ দুটো
আমার বড় পরিচিত মনে হল । কার মত এই চোখ দুটো ! তবে
যার মতই হোক বড় পরিচিত মনে হল ।
শশী এখনও আমার কোল থেকে নামে নি । আমাকে কেমন
জড়িয়ে ধরে রেখেছে । হঠাৎ জয়িতা ওর মোবাইল দিয়ে
আমাদের ছবি তুলল । বেশ কয়েকটা । আমি বললাম
-কি করছো ?
-আমার মেয়ের জন্য ছবি তুলছি ? তুমি যখন থাকবে না এই
ছবি ওকে তোমার কথা মনে করাবে ।
আমি ঠিক মানে বুঝলাম না । কেবল হাসলাম । জয়ি
শশীকে বলল
-মামনি তুমি একটু ভিতরে যাও ! আমি একটু আবীরের
সাথে কথা বলি !
-আমি থাকি না আম্মু ! বাবার সাথে তো আর থাকতে
পারবো না ।
কথাটা শুনে আমি ধাক্কার মত খেলাম । শশী কি বলল !
বাবা !!
আমার ঠিক তখনই মনে পরে গেল শশীর চোখ দুটো কেন
এতো পরিচিত মনে হচ্ছিল । আয়নার দিকে চোখ পড়লে
যে ঐ দুচোখ প্রতিদিন আমি দেখি ।
আমার বুকের মধ্যে কেমন একটা অনুভুতি শুরু হল । আমি
জয়িতার দিকে তাকালাম । জয়িতার চোখ দুটো কেমন
যেন অস্বস্থির । এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করছে ।
----
জয়িতার খোজ পাচ্ছিলাম না কিছুদিন থেকেই ।
কোথায় যেন ডুব মেরেছে । ওর ফোনও বন্ধ । একদিন হঠাত্
করেই আমার বাসায় এসে হাজির । ঐ দিন বাসায় একলা
ছিলাম । মা গ্রামের বাসায় গেছিল । রাত তখন প্রায়
এগারটা বাজে । এমন সময় জয়িতা এসে হাজির । ওকে
এতো রাতে আসতে দেখে খানিকটা অবাক না হয়ে
পারলাম না ।
-এতো রাতে ? এতো দিন কোথায় ছিলি ? আর তোর এই
অবস্থা কেন ?
জয়িতাকে কেমন জানি এবনরমাল মনে হচ্চিল । একটু
যেন টলছিল । জয়িতা বলল
-ড্রিংক করেছি ।
-মানে ? কেন?
আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম । কি বলে এই মেয়ে ?
খানিকটা ধরেই ওকে ঘরের ভেতরে নিয়ে এলাম । ওর
কেমন জানি হুস নাই মনে হল । আমাকে বিড় বিড় করে
বলল
-খুব ঘুম আসরে আবীর । একটু ঘুম পাড়িয়ে দিবি ?
-আয় ।
ওকে নিয়ে শোবার ঘরের দিকে গেলাম । যাওয়ার পথেই
ও আমাকে জড়িয়ে ধরলে । যখন ওকে বিছানায় শুইয়ে
দিলাম জয়ি তখনও আমাকে ছেড়ে দিলো না । ঘোলা
চোখ নিয়ে আমাকে বলল
-একটু আদর করবি আবীর ?
আমার প্রথমে মনে হল ওর হয়তো হুস নেই তাই কি করছে
না করছে তার ঠিক নেই । কিন্তু ওর চোখের দিকে যখন
ভাল করে তাকালাম আমার পুরো শরীরটা কেমন যেন
কেঁপে উঠল ।
সেদিন আমার কি হয়েছিল জানি না কিন্তু মনে
হয়েছিল জয়িতাকে এর আগে কথনও এতো আপন করে
ভালবাসি নি । রাতে ঘুমানোর আগে কেবল এই কথাটা
মনে হল এই জয়িতাকে ছাড়া আমার চলবে না কিছুতেই ।
কিন্তু সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে জয়িতাকে আর
দেখতে পেলাম না । কেবল আমার মোবাইলের নিচে
চাপা দেওয়া এক টুকরো কাগজ পেলাম ওর । এলোমেলো
হাতে লেখা অল্প কয়েকটা লাইন
"আর কয়েক ঘন্টা পরেই আমার ফ্লাইট । বাবা কাছে
যাচ্ছি । তোকে ছেড়ে যাচ্ছি । কাল এ কথাটাই বলতে
এসেছিলাম । যেন বলতে পারি তাই খানিকটা ড্রিংক
করে এসেছিলাম । তবুও বলতে পারি নি । তার বদলে কি
হয়ে গেল দেখ ! যাগ গে তুই টেনশন নিস না । যা হয়েছে
ভালই হয়েছে । তুই ভাল থাকিস । আর আমার কথা মনে
রাখিস । তোকে অনেক ভালবাসি"
------
আমি কোন মতে বললাম
-শশী কি বলল আমাকে ?
জয়ি চুপ করে থাকলো অনেকক্ষন ।
- কি ব্যাপার কথা বলছো না কেন?
তারপর হঠাৎ করেই জয়ি কথা বলা শুরু করলো ।
-যখন বাবার কাছে পৌছালাম তখনও আমি ভেবে পাই
নি আমি কিভাবে বেঁচে থাকবো । কিন্তু ওখানে যাবার
কিছুদিনের মধ্যেই আমি টের পেলাম আমার মধ্যে কিছু
একটা হয়েছে । যখন সিওর হলাম কি যে আনন্দ লাগছি
আমার কাছে ! তুমি নেই তবুও তোমার অস্তিত্ব আমার
কাছে আছে । আমার বাঁচার অবলম্বন ।
-আমাকে তুমি একবার জানাতে পারতা না ?
জয়িতা হাসলো !
-তাহলে তোমাকে আটকানো বড় কঠিন হয়ে যেত ।
অনেক কিছু বলতে চাইলাম । কিন্তু তারপর মনে হল কি
দরকার ? কি লাভ এখন এসব জিজ্ঞেস করে !
আমি কেবল শশীকে জড়িয়ে ধরে রাখলাম । আমার
মেয়েকে জড়িয়ে ধরে রাখলাম । জয়িতা বলল
-শশী জন্মাবার পর থেকে আমার পুরো জীবনটাই যেন
বদলে গেল । আমার পুরোটা সময়ই কাটতো ওকে নিয়ে ।
জানে ওকে যখন জয়িয়ে ধরতাম মনে হত যেন তোমার
গন্ধ আমি পাচ্ছি ওর গা থেকে ।
আমি বললাম
-কোন অসুবিধা হয় নি তোমার ? না মানে তুমি একা
একটা মেয়ে হয়ে .... !
জয়িতা হাসল ।
-নাহ ! তেমন কোন সমস্যায় পরতে হয় নি । বোঝই তো
ওখানকার কালচারটা মোটামুটি এরকম । অবশ্য বাবা
প্রথম প্রথম একটু নাখোস ছিল । কিন্তু পরে আর কিছু বলে
নি ।
আমি বললাম সব
-তো ভালই চলছিল । তাহলে দেশে কেন এলে ?
-গত বছর শশী ওর বাবাকে দেখার জন্য খুব চিত্কার
চেঁচামিচি শুরু করে দিল । স্কুলে সবার বাবা আসে ওর
বাবা কেন আসে না । বাবা কই ? বাবা কই ? এই নিয়েই
সারাদিন কান্নাকাটি চলত । তাই ওকে প্রমিজ
করেছিলাম যে সামনের জন্মদিনে তোমার বাবাকে
এনে দিবো ।
আমি কিছু বললাম না । শশীর দিকে তাকিয়ে রইলাম ।
কি শান্ত ভঙ্গিতেই না ও আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে ।
জয়িতা আবার বলল
-আমি ভেবেছিলাম ওর হয়তো মনে থাকবে না । কিন্তু
শশী ওর বাবার কথা ভুলে যাই নি । এই বার আর কিছুতেই
ওকে সামলাতে পারছিল না । তোমার মেয়ে না ?
তোমার মতই হয়েছে । একবার কিছুতে হ্যা বললে আর না
বলার উপায় নাই ।
আমি শশীকে কোলে নিয়েই বসে রইলাম অনেকক্ষন ।
কোন কথা বললাম না । কেবল বসেই রইলাম । খুব ইচ্ছা
করছিল শশীর সাথে কথা বলি কিন্তু কোথা থেকে যেন
একটা বাঁধা আসছিল বারেবার ।
যখন আমার ফেরার সময় হল শশীকে কোল থেকে
নামালাম । শশী বলল
-তুমি কি এখন চলে যাবে ?
আমি কথাটার জবাব দিতে পারলাম না । কেন জানি
মনে হচ্ছিল এখনই আমার চোখে পানি চলে আসবে ।
পকেটে যা টাকা ছিল প্রায় সবটুকু শশীর হাতে তুলে
দিলাম । ওকে বললাম
-মামনি তোমার যা ইচ্ছে কিনে নিও ।
জয়িতা বলল
-কেউ কিছু দিলে থ্যাঙ্কিউ দিতে হয় !
-থ্যাঙ্কিউ ।
মা মেয়ে দুজনেই একদম নীচ পর্যন্ত এল আমাকে এগিয়ে
দিতে । যাবার আগে জয়িতা আমাকে বলল
-আবীর তুমি মনে কখনও যেন কোন অপরাধ বোধ রেখো
না । কেমন ! হয়তো তোমার সাথে থাকলে আমি আরো
একটু ভাল থাকতাম । তবে এখন কিন্তু আমি খারাপ নেই ।
বরং অনেক ভাল আছি । তুমিও ভাল থেকো কেমন ।
আমি রিক্সায় উঠে পড়লাম । শশীকে বললাম
-ভাল থেকো মামনি ।
-তুমিও ।
মিষ্টি একটু হাসল । শশীর ঐ হাসিটুকু দেখে সত্যি বুকের
মধ্যে কেমন যেন এক অজানা শূন্যতার সৃষ্টি হল । জয়িতা
যখন আমাকে ছেড়ে গেছিল তখন যেমন ওর প্রয়োজনীতা
অনুভব করতাম । আজও ওর অভাব অনুভুত হচ্ছে । ওদের
দুজনের অভাব !
-ছার আপনে কানছেন ক্যান ?
-হুম কি বললে ?
রিক্সায়ালার কথায় বাস্তবে ফিরে এলাম । চোখে হাত
দিয়ে দেখলাম সত্যিই আমার পানি পরছে ।
-না ঠিক কাঁদছি না । চোখের মধ্যে কি যেন এসে
পরেছে তাই পানি পরছে ।
রিক্সা এগিয়ে চলছে টুংটাং শব্দ করে । আমিও এগিয়ে
চলেছি এক জীবনকে পিছনে ফেলে অন্য এক জীবনের
কাছে ।
{ ইন্টারনেট হতে সংগ্রহীত } কবির তালুকদার। হাইমচর, চাঁদপুর।